Home literature অর্থ-কল(The Maze of Meaning)

অর্থ-কল(The Maze of Meaning)

0

কী! এটা কী করে সম্ভব? এই তো কালকেই…
খবরটা সুবীর কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। স্বাভাবিক। অম্লানের  মৃত্যুতে আর কারো এসে যাক বা না যাক, ছোটোবেলার বন্ধুদের মধ্যে সুবীরের এসে যায়। আর আসবে নাই বা কেন,ছোটো থেকেই চুপচাপ, ইন্ট্রোভার্ট সুবীরের ওই একজন বন্ধুই তো ছিল যে তাকে বুঝতো ঠিক মতো। টিফিন ভাগ হোক কিংবা নাক দিয়ে গড়ানো রেলগাড়ির স্বাদের রিপোর্ট ভাগ,সব‌ই তো এই একটা বন্ধুই জানতো।

সুবীর বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ এক সম্মাননীয় কর্মচারী,পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান ও উপর থেকে গম্ভীর। বয়স পঞ্চাশের ঘরে, স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসন্তানের ছোট্ট,সুখী ও স্বচ্ছল পরিবার নিয়ে সংসার। স্ত্রী কনিকা বিশ্বাস,মিসেস বিশ্বাস তকমাতেই জীবনের চিরপরিচয় ঘটিয়েছেন ও আদরের একমাত্র কন্যা সুরশ্রী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজীতে স্নাতকোত্তর। আদর্শ পরিবারের আখ্যা না পেলেও, বিশ্বাস পরিবার বাংলা সিরিয়ালের কূটকচালিভরা পরিবারতন্ত্র থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে। গোটা চন্দননগর না হলেও বাগবাজার এলাকায় সুবীর বাবু ‘স্বামী’-দা নামেই খ্যাত। এরকম অদ্ভুত নাম দেখে সকলেই চমকে যেতে পারে তবে বিবেকানন্দের ভক্ত ও আদর্শে অনুপ্রাণিত সুবীরকে, পাড়ার হরুদার চায়ের ঠেক এই উপাধিতেই ভূষিত করেছে। ব্যাস,বাকীটুকু বাঙালীর পর-নিন্দা-পর-চর্চার ফল আর কী!

সকালটা আজ রোদ ঝলমলে হলেও চারিপাশের আলোটুকুও চোখের আওতায় আসছে না। সাতসকালে আর যাই হোক প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ সে হজম করে উঠতে পারে নি। বারবার প্রশ্ন আসছে মনে অম্লানের পর সুমনার কী হবে, আকাশটা এখনও বেশ ছোটো, ব্যাপারটা মানতে পারবে কি না, সুবীরের মতো তার‌ও যে এক ছেলে ও স্ত্রীর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে রোজের অভ্যাস মতো শেভিং ক্রিমটা হাতে তুলে খেয়াল হতেই আবার রেখে দিল সুবীর;মেয়ের ঘুমন্ত মুখটা অপলক দেখে দরজাটা আলতো করে ভেজিয়ে নীচের ডাইনিং টেবিলে এসে বসতেই এতক্ষণে কনিকার গলার স্বরে সে খানিকটা সম্বিত ফিরে পেল।
“হ্যাঁ গো,সব ঠিক আছে তো?”
“কী…কী? হ্যাঁ… হ্যাঁ সব ঠিক আছে।”
“দেখে তো মনে হচ্ছে না! কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি, তুমি খাবারটা একটু তাড়াতাড়ি দেবে প্লিস্?”
রবীবাসরীয় লুচি-আলুছক্কা টেবিলে হাজির, সাথে পছন্দের ডিমের পোচ। পোচটার দিকে তাকিয়ে সুবীর আবার হারিয়ে গেল…

“এই জানিস আজ টিফিনে কী এনেছি?”
“কীরে? পরোটা-আলুরদম?”
“আরে ধূর পাগল! আজ ইংরিজি খাবার!”
“ইংরিজি খাবার! কী আছে?”
“টোস্ট আর এগপোচ।”
সুবীর বিস্ময়ে বলে উঠল,”এগ পোচ!”
আর সঙ্গে সঙ্গে চকের তীক্ষ্ণ ফলা তার চশমা ঝাপসা করে দিল।
এই যে জগাই-মাধাই,বাবা উঠে পড়ো দিকি!”
বাজখাঁই গলায় কালীশঙ্কর বাবু হেঁকে উঠলেন। পেশায় ইংরাজী মাস্টার কালীশঙ্কর বোস আদব কায়দা ও বেশভূষায় এমন‌ই এক পরিবেশের সৃষ্টি করেন, যাতে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে ব্রিটিশ চলে গেলেও কুম্ভের মেলায় হারানো ভাইটিকে ভারতের ভার দিয়ে গেছে।
দুই বন্ধু ধরা পড়া চোরের মতো বাধ্য শরীর দুটো নিয়ে দাঁড়াল। কালীশঙ্কর বাবু আরেকবার সারা ক্লাস গমগমিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন-
“তা আমার ক্লাসে কী দেশোদ্ধার হচ্ছে শুনি?”
“আজ্ঞে স্যার,ও-ও টিফিনে এগ পোচ এনেছে সেটা শুনছিলাম।”- সুবীর  ভিজে বেড়ালের মতো গড়গড়িয়ে গেল।
“বাবা! তা রানি ভিক্টোরিয়ার দরবার থেকে এসেছে এ পোচ্?”
“না স্যার,মা পাঠিয়েছেন।”
“চোপ! আবার মুখে মুখে কথা! পোচ্ বানান বল দিকি?”
“প-এ ও-কার চ,পোচ্।”
থমথমে ক্লাসে হঠাৎ কে ফিক করে হেসে উঠলো আর বাকি শেয়াল‌ও ডেকে উঠলো।
“হারামজাদা! এদিকে আয় তোরা!”
দুই বন্ধু বিপত্তারিণী ডোর গুলো ছুঁয়ে চোখ বুজে আকুতি করে এগিয়ে গেল বাঘের মুখে।
“হাত পাত!”
দুজোড়া হাতে সপাৎ সপাৎ করে কঞ্চি আর মাস্টারমশাইয়ের ধারাপাত এগোতে লাগলো-
“P,O,A,C,H- Poach। পৃথিবী বদলে যাবে, ভাষার রূপ বদলাবে তবুও এই গাধা দুটো এক‌ই থাকবে।”
মা বিপত্তারিণীও সেদিন কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভক্তের আর্তনাদ শুনতে পান নি বোধহয়।

“কী গো?কী হয়েছে? শরীর খারাপ করছে?”
“না,না, আমি ঠিক আছি।”
“নাহ্, কিছু তো একটা হয়েছে। সকাল থেকে অন্যমনস্ক,এখন খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,তাও খাচ্ছো না। কী হয়েছে বলো তো?”
এইবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না সুবীর।
“অম্লান মারা গেছে গতকাল ভোররাতে।”
“সে কি! কী করে হলো? কখন জানলে?”
“ফোনেই খবর এলো একটু আগে।”
“তুমি ফোন করেছ ওর বাড়িতে?”
সাহস হচ্ছিল না ফোন করবার।কী বলব, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“সে কি কথা! শিগগিরই ফোন করো।”
ব‌উয়ের কথায় ভরসা পেয়ে সুবীর অম্লান ফোন লাগালো।
রিং হচ্ছে।
সপ্তাহখানেক আগে কেনা নতুন স্মার্টফোন কানে,তার মনে পড়ছে গত পরশুই অফিসের পরে অম্লানের সাথে দেখা, আড্ডা দিলো জমিয়ে তারপর সুবীরের ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করিয়ে বন্ধুদের গ্রুপে অ্যাড করে বলল
“দেশ এখন ডিজিটাল বুঝলি। ইন্টারনেট‌ই ভগবান!”
“হ্যালো সুবীর দা।” সুমনা নির্মল স্বরে বলল।
“হ্যালো, সুমনা। খবরটা শুনলাম।” গলাটা ভিজে তার।
“খবর? কী খবর?”
সুবীর বিহ্বল স্বরে,”অম্লান…”
“হ্যাঁ দাদা, ও তো বাথরুমে। ও বেরোলেই আপনাকে ফোন করতে বলছি।”
“আচ্ছা দাদা এখন একটু রাখছি। কড়াইতে তেল গরম হয়ে গেছে তো। ও বেরোলেই আপনাকে ফোন করতে বলছি।”

ফোনটা কানে থেকে সরিয়ে সুবীর ফ্যালফ্যাল করে কনিকার দিকে চেয়ে।

“আরে কী হলো বলবে তো?”
“অম্লান…অম্লান এখন বাথরুমে আছে।”
“বাথরুমে। মানে বেঁচে আছে! আমি আর পারছি না এই লোকটাকে নিয়ে। সাতসকালে যাকে তাকে মেরে দিচ্ছে গো… হ্যাঁগো,মাথাটাথা ঠিক আছে তো? ডাক্তারের কাছে যাবে?”
“আরে ধ্যাৎ। কী বলছো? এই দেখো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লেখা আছে, অম্লান হ্যাস লেফ্ট।”
“তার মানেই কি সে মারা গেছে?কী মুশকিল! আমি কাকে নিয়ে সংসার করছি। জীবন পুরো কয়লা করে দিলো গো।”

সুবীর বুঝল এই সমস্যার সমাধান হিয়া ছাড়া কেউ করতে পারবে না। সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়ে মেয়ের ঘরে গিয়ে ঢুকলো।
শান্ত মুখে মেয়েকে শুধোলো,
“হিয়া,অ্যাই হিয়া ওঠ্ তো একবার।”
হিয়া রোববারের আয়েশী ঘুমের ঘোরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়ল।
“এই ওঠ্ না।”
এইবার সে কষ্টে উঠে বাবার দিকে তাকিয়ে ঠায়,বেচারী এটুকুও বুঝতে পারছে না যে সে হিয়া না সুরশ্রী! ঠাহর করে পরে বলল,
“কী হয়েছে?”
“হিয়া, হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ লেফ্ট মানে কী রে?
একটু কিছুক্ষণ তাকিয়ে অবশেষে হিয়া হেসে বলে,
“গ্রুপলেফ্ট মানে বাপী সেই মানুষটা কোনো কারণে গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গেছে।উফফ্,সরো আরেকটু ঘুমিয়ে নিই।”

ঘেঁটে যাওয়া কিশোরের মতো দাঁড়িয়ে সুবীর; চোখ জানালা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ওপারের বড়ো হোর্ডিংয়ে Jio Digital Life-এর উপর নাচছে আর কালীশঙ্কর স্যার ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে বোঝাচ্ছেন-
“একটি verb-এর একাধিক প্রয়োগ থাকতে পারে।এই ধরো Leave এর past tense Left
‘He left the match.’-এই বাক্যে ‘Left’ মানে সে ম্যাচ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
‘He left us forever.’-এই বাক্যে ‘Left’ মানে সে পরলোকগমন করল।বুঝলে?”

সুবীরের উপলব্ধির ঘূর্ণির বিরতি ঘটায়, অম্লানের কল আর কাকতালীয় ঘটনার সমীকরণ মেনে পাশের বাড়ির রেডিওতে বেজে ওঠে-
‘গোলমাল হ্যায় ভাই সব গোলমাল হ্যায়…’


NO COMMENTS

Leave a ReplyCancel reply

Exit mobile version